মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিলের প্রথম দিনের শুনানি শেষ হয়েছে। শুনানিতে আইনজীবী বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেছেন।
মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন। শুনানিতে জামায়াত নেতাদের বিচার ও সাজা কার্যকর নিয়ে প্রশ্ন তুলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার প্রসঙ্গ টেনে শিশির মনির বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর খারিজ করা হয়। পরে সংক্ষিপ্ত আদেশে ওইদিন রাতেই তড়িঘড়ি করে তার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন করার জন্য এ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ কী কারণে খারিজ হলো- সেটা আমরা জানতে পারিনি।
শিশির মনির বলেন, সাধারণত আসামির মুক্তির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ ফলো করা হয়। তবে কারো ফাঁসির জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশ এটা প্রথম ঘটনা। উপমহাদেশে এমন নজীর আর নেই।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। আপিলকারীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করে দেওয়া আদেশ তুলে ধরেন। এরপর কোন কোন অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ আজহারুলকে কী দণ্ডাদেশ দিয়েছেন- তা শুনানিতে তুলে ধরেন এই আইনজীবী।
এর আগে আপিল বিভাগ গত ২২ এপ্রিল আজহারুলের করা আপিল সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৬ মে দিন ধার্য করেন। এর ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার শুনানি শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, পূর্বে এটিএম আজহারের পক্ষে ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক শুনানি করলেও তার বাবা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক মারা যাওয়ায় মঙ্গলবার শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মনির।
শিশির মনির বলেন, নির্বাচনের আগে ফাঁসি দিতে হবে- এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই তড়িঘড়ি করে তা করা হয়। তিনি আরও বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের পর কেন তা খারিজ হলো, সে বিষয়টি রায়ে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হলেও সংক্ষিপ্ত রায়ে তা লেখা হয়নি। সাধারণত সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়া হয় আসামিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময়। কিন্তু এখানে তা উল্টোভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শিশির মনির বলেন, সাক্ষী ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর কোর্টে আসার পর দেখলাম সে ঘটনার তারিখ-সময় বলতে পারছে না। পরে অনেক সাক্ষীকে কোর্টে আনা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ওই সময় ১৭ জনের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছিল এরা আদালতে আসতে পারবে না। ট্রাইব্যুনাল ওই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। যার কারণে আসামিপক্ষ অনেক সাক্ষীকে জেরা করতে পারেনি। অথচ সাক্ষীদের জেরা করা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এটাই সাক্ষ্য আইনের বিধান। অথচ জেরা না করতে অ্যাক্ট ও রুলস পরিবর্তন করা হয়েছিল।
শুনানিতে শিশির মনির বলেন, ‘যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো থানায় একটা সাধারণ ডায়েরিও ছিল না। চাক্ষুস যেসব সাক্ষীর ভিত্তিতে এটিএম আজহারকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। এসব সাক্ষীর অনেকেই ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছেন। যা বৈজ্ঞানিকভাবে একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফাঁসি দেওয়াটা আইনত ঠিক হয়নি।’
শিশির মনির বলেন, ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আসার সুযোগ ছিল না। বিচারটা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তখন আমরা স্কাইপ কথোপকথন, মেইল যোগাযোগের বিষয়গুলো বারবার বলেছি। সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল। আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়ে আবেদন করলে- তা খারিজ করেছিল ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে না চাইলে তাকে আদালত থেকেই কারাগারে পাঠানো হয়।
জামায়াত নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে শিশির মনির বলেন, ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছিল। সারা দেশে ২৮টি ট্রাইব্যুনাল করে বিচার শুরু হয়েছিল। অথচ ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতাদের বিচার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো থানায় জিডি পর্যন্ত ছিল না। ১৯৭৩ সালের ওই আইন সংশোধন করে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার সিভিলিয়ানদের বিচারের বিধান করে। বিষয়টি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন প্রয়াত বিচারপতি টিএইচ খান। সেখানে দেশি-বিদেশি আইনজ্ঞরাও অংশ নিয়েছিল। তারা বলেছিল এই আইন ও ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিকমানের ছিল না।
এটিএম আজহারের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী ৬ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এটিএম আজহার ট্রেন থেকে নেমে গ্রামে আগুন দিয়েছেন। ঘটনার স্থান বর্ণনা করা হয়েছে এক জায়গায়, সাক্ষী বলছে অন্য জায়গায়। একজন সাক্ষী বলছে, তার ছেলেমেয়ে কয়টি- তা সে জানে না। তার সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে। একজন সাক্ষী বলেছে, তার বাবাকে কে মেরেছে- তা তিনি দেখেননি, বাবাও তাকে বলেননি। অন্য একজন বলেছেন, এটিএম আজহার মেরেছেন। একজন সাক্ষী পাচক। তিনি কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষকে চিনেন না, অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চিনেন না। অথচ তিনি আজহারুল ইসলামকে চিনেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, একজন সাক্ষী বলেছে- এটিএম আজহার ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত নন। অথচ আপিল বিভাগ বলেছেন, এখানে এই কথা সত্য নয় ধরে নিতে হবে।এসব সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এটিম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেছেন, এসব সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য না। পরে কয়েকটি অভিযোগ থেকে ওই বিচারপতি তাকে খালাসও দেন।
শুনানি শেষে আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ শুনানি শেষ হয়েছে। আবার বৃহস্পতিবার শুনানি করব।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলসহ আরও অনেকে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন তিনি। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে আজহারুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল। এই পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আজহারুল বর্তমানে কারাগারে আছেন।